
শাইখ মুহাম্মাদ জামাল উদ্দীনঃ আজ আমরা দেশ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি, সমাজকে কল্যাণের পথে ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা করি। কিন্তু এই পরিবর্তনের জন্য সৎ নেতৃত্ব অপরিহার্য। কেননা নেতা যেমন হয় জাতিও তেমন হয়। যদি নেতা সৎ হয়, নিরপেক্ষ হয়, আল্লাহভীরু হয়, তবে পুরো জাতিই আলোকিত হয়। কোরআন ও হাদিসের আলোকে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন এবং বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে পারি। অতএব আজ প্রয়োজন আত্মত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক সংস্কার সাধন। একটি জাতির ক্ষয়ে যাওয়া নৈতিকতা, লুট হওয়া অর্থনীতি, মৃতপ্রায় সামাজিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন আমূল পরিবর্তন। আর এ পরিবর্তন বা সংস্কার হতে হবে কোরআনের হেদায়াত অনুযায়ী। যেভাবে জাহেলিয়াতের আধারে ডুবে থাকা একটি জাতিকে নবীজি (সা.) আলোর পথে এনেছেন কোরআনের মাধ্যমে। দেশ সংস্কার বা জাতির সংশোধনের জন্য অনেক দিকেই নজর দেওয়া জরুরি। তবে সবার আগে নজর দিতে হবে নেতৃত্বে। নেতা ভালো হলে দেশ ভালো হয়ে যায়। নেতা খারাপ হলে দেশ কখনো এগোতে পারে না। ভালো নেতা কাকে বলে? যিনি সর্বক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন তিনিই ভালো নেতা। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) সাত ব্যক্তির ব্যাপারে সুসংবাদ দিয়েছেন যারা কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবেন। তাদের প্রথমজন হলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক বা ভালো নেতা। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) কোরআন-হাদিস নিংড়ে ভালো নেতার গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, নেতার জন্য প্রথম ফরজ হলো নিরপেক্ষ হওয়া। তার অধীনে প্রশাসনিক যত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে সবাই যেন নিরপেক্ষ থাকে এ বিষয়টি নিশ্চত করাও নেতার প্রথম ফরজ কাজ। নেতাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, কোনোভাবেই যেন দল-গোষ্ঠী -গোষ্ঠী কিংবা মত বিবেচনায় প্রশাসক নিয়োগ না দেওয়া হয়। বরং প্রশাসক নিয়োগ হবে আল্লাহভিরুতা, জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে। আর এসব কিছুর ক্ষেত্রে সততা হবে প্রধান যোগ্যতা। এ ব্যাপারটি যদি নিশ্চিত করা যায়া, তাহলে অতি দ্রুতই হারিয়ে যাওয়া নৈতিকতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ ফিরে আসবে। তবে শতভাগ আন্তরিক চেষ্টার পরও যদি কোথাও কোনো ভুল থেকে যায়, তাহলে আশা করা যায় মহান আল্লাহ সেই ভুল ক্ষমা করে দেবেন। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে বিশ্বাসীরা। তোমাদের সাধ্যমতো আল্লাহকে ভয় করো।’ (সূরা তাগাবুন, আয়াত ১৩) অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘কারও সাধ্যের বাইরে কোনো দায়িত্ব আল্লাহ চাপিয়ে দেন না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৩) রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কোনো কাজের নির্দেশ দিলে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে করবে।’ (সহিহ বুখারি) আমরা দেশ সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। যুগে যুগে যত নবী-রাসুল এসেছেন, সবাই ছিলেন একেকজন সেরা সংস্কারক।
নবী-রাসুলদের পর অলি-আউলিয়া ও মুজাদ্দিদরা সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজ যারা সংস্কারের জোয়াল কাঁধে নিয়েছেন, সবাই আসলে নবীওয়ালা দায়িত্বই পালন করছেন। আর নবীওয়ালা দায়িত্ব পালন করতে গেলে সবার আগে কোরআনের কাছে আসতে হবে। কোরআন যেমন সমাজ চায়, সেই সমাজের রূপরেখা জনগণের সামেন তোলে ধরতে হবে। কোরআনের প্রথম চাওয়া হলো, সব মানুষকে সমান হিসেবে বিবেচনা করা। আদম সন্তান সবাই সমান। এখানে ধনী-গরিব, মেধাবী-মেধাহীন, শক্তিশালী-দুর্বল, মালিক-শ্রমিক এসব বিবেচনায় মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। বরং সবাই মহান আল্লাহর বান্দা। পদ-পদবির কারণে কারও মর্যাদা কমবেশি করার সুযোগ নেই। বরং যার তাকওয়া বেশি সেই সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাবান মানুষ হবে। যখন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরপেক্ষ ও সততার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করা হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সব মানুষকে সমান বিবেচনা করে সমান সেবা দেওয়া হবে। সেখানে কেউ তদবিরের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে না। সরকারি সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে ঘুষের আশ্রয় নিতে হবে না, বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না এবং ভেজাল ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, সততা আগে নিজের থেকে আসে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা মনে করি, ওপরে নিচে সবাই অসৎ, আমি সৎ হয়ে কী উদ্ধার করব? কিন্তু কোরআন বলছে, আগে নিজের মুক্তি নিশ্চিত করো। তারপর অন্যদের ব্যাপারে ভাবো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দুশমনদের সঙ্গে লড়াই করো। নিজের মুক্তি ছাড়া অন্য কারও মুক্তির দায়িত্ব তোমাদের ওপর নেই। তবে হ্যাঁ। দাওয়াতের মাধ্যমে অন্যকেও অনুপ্রাণিত করতে পারো।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৮৪) অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবো। তোমরা যদি সততার পথে থাকো তাহলে অসৎ ব্যক্তিরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত ১০৫) সব মানুষকে সমান বিবেচনার পর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় কাজ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূর করা। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) যখন খেলাফতের দায়িত্ব নিলেন, তিনি রাতের পর রাত মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে খোঁজ নিতেন কারও কোনো অভাব-অনটন আছে কি না, তা জানার জন্য। তিনি রাতে বের হয়ে কাঁদতেন আর বলতেন, ফুরাতের তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। যখন মানুষের ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে, তখন ধীরে ধীরে অন্যান্য মৌলিক অধিকারগুলোও পূরণ হতে থাকবে। আর মহান আল্লাহর দুয়ার দেশবাসীর জন্য খুলে দেওয়া হবে। তখন দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের আধারে পরিণত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দেশের জনগণ যদি মুমিন ও খোদাভীরু হতো এবং সততার নীতি অবলম্বন করে জীবন পরিচালনা করত, তবে তাদের জন্য আমি আকাশ ও পৃথিবীর সব কল্যাণের দরজা খুলে দিতাম।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৯৩)